মুবা মিয়া :: দ্বিতীয় পর্ব
“গোলা তো ভরা অইলই, তই গোয়ালপাড়ায় যদি কয়ডা গরু থাকত” নতুন ধানের গন্ধে গোলাভরে-ভরে ঘরে-ঘরে প্রায় কোণঠাসা অবস্থা, কৃষকদের মুখে কুটিকুটি হাসির রেখা, রাস্তায় নতুন-নতুন লুঙ্গি পরে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে ফুটন্ত হাসি নিয়ে এখানে সেখানে আড্ডা জমছেই “কার গোলায় কত মণ ধান”, তবুও এমন অপ্রাপ্তি যেনো প্রতিটা কৃষকের মনেই। অবশ্য জগৎ জুড়েই এমন অপ্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাস।
গ্রীষ্মের দহনে বর্ষা যেনো পোষমানা পাখির মতো উড়ে চলে এলো। বৈশাখ শেষে জৈষ্ঠ্যের ছোঁয়াতেই পানির উপচে পড়া ভিড়ে নদী-হাওড়, বিল-পুকুরের সকল বাঁধ ভেঙে বর্ষার মুষলধারে বৃষ্টি ও জোয়ারজলে মাঠ-ঘাট সব তলিয়ে যাচ্ছে একের পর এক। বিল-হাওরের ব্যঙ, ইঁদুর, চিকাগুলো এসে মানুষের বসত ভিটায় আশ্রয় নিচ্ছে কোনরকম। মেঘের ভারী বর্ষণে ঘাট-বাটের শক্ত পিচ্ছিল মাটিতে ঠুসঠাস আছাড় খেয়ে সপ্তাহ-দু’সপ্তাহ ধরে অনেকেই শয্যাযাপন করছে ধুঁকে-ধুঁকে । শক্ত ইটে পা রাখতেই নিচ থেকে সিরিঞ্জের মতো ছিঁটকে এসে কাপড়ে কাঁদা ছিটকে আসা অবস্থা বাড়ির ভিতর দিয়ে প্রতিটা চিপাগলিতেই। হাঁটুগেঁড়া কাঁদায় হাঁটতে-হাঁটতে একেকজনের পায়ের তলা আবার একেকটা মালভূমির মতো হয়ে উঠেছে। জলচরের ঝোপঝাড় হতে ব্যঙের ঘ্যঙরঘ্যঙ শব্দে ঘুমন্ত মানুষদেরও কানফাটা অবস্থা। ছোট পোলাপানেরা সেই যে পানিতে নেমেছে তো নেমেছেই। কেউ কলারভুড়া লয়ে, কেউ তেলের বোতল লয়ে, কেউ ফুটবল লয়ে, কেউ বা আবার লুঙ্গি ফুলিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্রোতে ভেসে বেড়াচ্ছে। উঠবার কোনো নামগন্ধও নেই। শ্যওলামাখা শরীর আর গোলামরিচের মতো লাল চোখ নিয়ে যখন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরবে, তখন নিশ্চিত মায়ের হাতে ঝাঁটা-দৌড়ুনি একটারও নিস্তার নেই। সবক’টির কপাল মন্দ আজ।
আষাঢ়ে বৃষ্টির ফাঁকে জাম-আম কুড়াতে যেয়ে ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েদের নাক-মুখ ছিঁড়ে আসা নিত্যনৈমিত্যিক ব্যপার। কেউ-কেউ তো আবার ময়না পাগলার মতো সারাদিনই এ-বাড়ি হতে ও-বাড়ি, ও-বাড়ি হতে এ-বাড়ি ডিউটি দিতেই আছে, যেনো এ দুনিয়ায় সবচেয়ে সুখী মানুষ সে-ই। লাটিমের ভনভন ঘূর্ণিতে কারো তো আবার ভাত-ছালম খাওয়ার কথাও মনে থাকছে না। মুরব্বিদের কথা আর কী-ই বা বলার আছে! বিছানায় হুঁকা টানা ছাড়া যেনো দুনিয়ায় তাদের আর কোনো কাজকর্মই নেই। অবশ্য সারাদিন আল্লা-বিল্লায় কাটিয়ে দেওয়াও এ বয়সের একটা মহৎকর্ম। কে কোন সময় চলে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই! তবুও যদি কিছু নিয়ে কবরে পা ফেলতে পারে।
আসর শেষে মাগরিব ছুঁই-ছুঁই। পশ্চিমাকাশে গোধূলির আলোমাখা আকাশপটের লালভায় সন্ধ্যাকে স্বাগতম জানাতে অপেক্ষা করছে মুবা মিয়া ও তার দুই সহপাঠী নিরঞ্জন ও সুমন। জৈষ্ঠ্যমাসে মাছে পাড়া ডিমগুলো এতদিনে হয়তো ভালো সিয়ানা হয়ে উঠেছে। দশমী চাঁদটাও আজ আকাশে ঠিক সময়ে আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠবে হয়তো। এ ক’দিন যাবৎ একটানা বৃষ্টির পর আজ আকাশটা বেশ, থমথমে, মেঘশূন্য। মৃদু বাতাশে মৃদু ঢেউ। বেশ উপভোগ্য হবে। তারা তিনজন আজ হাওরে যাবে মাছ ধরতে। নিরঞ্জন ও সুমন মুবা মিয়ার ছোট হলেও মাছ ধরায় খুব দক্ষ। তাই, মুবা মিয়া তাদের দু’জনকে নিয়েই এবার জাল-নৌকা করেছে। মুবা মিয়া বাড়ির আড়ায় নারকেল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে গোধূলির ডুবন্ত সূর্য দেখছে। ছেলে ইব্রাহিম তার পাশেই বাবার তর্জনী ধরে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে পোলাপানদের জল-ছিটানো খেলা দেখে খিলখিলিয়ে হাসছে।
জাল, ছইড়, হ্যান্ডেল ইত্যাদি নিয়ে সুমন সেই কখন থেকেই নৌকায় বসে পা নেড়ে-নেড়ে কুমড়োবিচি ভাঁজা মুখে পুড়ে দিয়ে মনে-মনে গুনগুনিয়ে গান গাচ্ছে। মুবা মিয়া লুঙ্গির ভাঁজে বিড়ির পুটলিটা গোজে নিচ্ছে এমন সময় হঠাৎ সুমনের চিৎকার করা আওয়াজ ভেসে আসল মুবা মিয়ার কানে,
সু~ কিও মুবা ভাই, নামবানি নিচে, নাকি আন্ধার অইলে আন্ধাভুলায় ধরাইবা? আর হালা নিরঞ্জন তো অহনও দেহি বউয়ের আঁচলের তল কুডুরকুডুর করতাছে। নামে না কেন তাড়াতাড়ি, অয়?
মু~ আজানডা দেখ। নামতাছি। আজানের সময় কোনোহানো রওয়ানা দিওন নাই।
সু~ আইচ্ছা। তাইলে নিরঞ্জনের বাইত ইব্রাহিমরে কুদ্দু পাডাও। হেয় কই মইজ্জা আছে কী জানি!
মু~ বাজান, তোমার নিরঞ্জন কাহারে একটু ডাক দিয়া আইবানি? আর আইবার সময় ঘরতে বৈডাডা নিয়া আইও।
ই~ আইচ্ছা, আব্বা।
বাড়ির আড়ায় নারকেল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে মুবা মিয়া। এতক্ষণে পোলাপানেরা পানি থেকে উঠে পড়েছে। পানিতে ঢেউ নেই। বাতাশ নেই। নিরব-নিস্তব্ধ। পাখির ডানা ঝাপটানোও স্পষ্ট কানে এসে বাজছে। কলসি কাঁধে ঘাট থেকে মহিলাদের পানি নেওয়াও শেষ। গোয়ালঘরের গরু ক’টা কোরাস সুরে হাম্বা-হাম্বা ডাকছে। এর মধ্যে ইব্রাহিম নিরঞ্জনের ঘর থেকে ফিরার পথে বৈঠাটাও নিয়ে চলে এসেছে।
ই~ আব্বা, নিরঞ্জন কাহা কইছে, তোমরা নাওকাত যাইয়া বইতা। কাহা ভাইল অইয়া আইতাছে অহনই।
মু~ আইচ্ছা, বাপ। বৈডাডা দেও। আর কাইলকা আমি আইলে মন করাইয়া দিও। গাছের নাইরকলডি দেহা যায় পাঁকছে। না পাড়লে পরে চোরে সাফার কইরা ছাড়ব।
ই~ আইচ্ছা। আব্বা, আমি তোমরার লগে আইজ মাছ ধরা যামু। (প্রায় কান্নার সুরে অনুনয়-বিনয় করে বলল, ইব্রাহিম)
মু~ কিও বাপ, তুমি এইডা কী কইলা? তোমারে না আমি বড় শিক্ষিত্ পোলা বানাইমু। তাইলে তুমি জালো ধরবা কিল্লিগ্গা? আর মাছ ধরা যাওয়ার কথা কইবা?
ই~ নাহ, আব্বা। আর কইতাম না। তাইলে, আমার লাগি হুনি কাইল্লা মাছ আনবা?
মু~ আইচ্ছা বাজান, আনমু নে। আর তোমার মারে কইও আইজ রাইতে আওরেই থাকমু। বাড়িত আইতাম না আইজকা রাইতে।
ই ~ আইচ্ছা, আমি কইমুনে ঘরো যাইয়া। কাইলকা কিন্তু মাদ্রাসাত যাইবার আগে আইয়া পইড়?
মু ~ আইচ্ছা, আব্বা। আমি বিয়ানে-বিয়ানেই আইয়া পড়মু।
এই বলে ছেলের কপালে একটা চুমু খেয়ে ঘাট বেয়ে নৌকার দিকে ধেয়ে চলল মুবা মিয়া। পৃথিবীতে এই চুমুর ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারবে না। এ এক চুমুতেই যেনো সন্তানের হাজার বছর বেঁচে থাকার নিঃশ্বাস।
পানি আড়া থেকে খানিকটা দূরে। বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে হিজল গাছটার তলায় কুতুব মিয়ার চা-দোকানের ভিটায় একটু একটু করে বেয়ে উঠছে। অবশ্য বাচ্চাদের খেলবার জন্য হালকা-পাতলা ফাঁকা মাঠ এখনও অবশিষ্ট আছে।
সুমন একপ্রকার বিরক্তি নিয়ে একা একা নৌকায় বসে আছে। মাগরিবের আজান ভেসে এল। লালাসমান আঁধারে ঢেকে যাচ্ছে। পাখিরা নীড়ে ফিরছে কিচিরমিচির শব্দে। মুবা মিয়ারা চলল জীবিকার খোঁজে। বৈঠা হাতে ঘাট বেয়ে নেমে নৌকায় এসে উঠল মুবা মিয়া৷ এরমধ্যে নরম-নরম কদম ফেলে নিরঞ্জনও চলে এসে নৌকায় উঠল, কিন্তু নিরঞ্জন কেনো যেনো বারবার পিছন ফিরে তাকাচ্ছিল। মনে হচ্ছে, ও মাছ ধরতে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ওর মনটা বাড়ির আঙ্গিনাতেই রেখে যাচ্ছে।
সুস্থির পরিবেশে কী সুন্দর নীল-পরিষ্কারাকাশ, কিন্তু রাতটা কী জানি কেমন যাবে। দিনের এমন অবস্থাতেও সচরাচর মেঘকে বিশ্বাস করা মুশকিল। এই রোদেলা এই বাদলা, হটাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসতে পারে।
মু ~ নিরঞ্জন, নাওডারে দেহি বালু জোকের লাহান কাইমড়াইয়া ধরছে। নাইম্মা একটু ঠেলা দে তো। আর সুমন ছইড়টা দিয়া ভর দে।
হইয়ো, মারঠেলা। হইয়ো, মারঠেলা। হইয়ো, মারঠেলা।
নৌকা ভাসল। সন্ধ্যা নামল। সুমন ইঞ্জিনে হ্যান্ডেল দিয়ে নৌকার গলুইয়ে যেয়ে বসল।
থেক,,,, থেক,,,,থেক,,,,থেক,,ক,,ক,,ক,,ক চলল নাও।
নিরঞ্জন মাথা নিচু করে নৌকার বাতার ছিঁদ্র দিয়ে উঠা পানি সেঁচতে লাগল। মুবা মিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৈঠার নিয়ন্ত্রণ ধরল।
চলল বেসে নৌকা লয়ে।
যাচ্ছে তারা মাছের খোঁজে।
গেরাম ছেড়ে হাওড় মাঝে।
সুবিশাল হাওর! এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামের দূরত্ব চোখের ঝাপ্সা দৃষ্টি। আবছা আলোয় আরো অস্পষ্ট হয়ে আসছে গ্রামখানি। দূর থেকে মনে হয় যেনো রাখালের ভেসে থাকা কলার ভুড়া। মৃদু স্রোতের তরঙ্গভিড়ে খড়, গাছের ফালি, বাঁশের ডগা একটা-দুইটা, আরো কত কি ভেসে বেড়ায় এখানে-ওখানে। কেউ কেউ আবার লাকড়ির সন্ধানে স্রষ্টার এই ভেসে আসা আশীর্বাদগুলোর খোঁজে সারাদিন বাড়ির দক্ষিণ আড়ায় বসে থাকে। মৃদু ঢেউয়ে দুধের মাঠার মতো কী সুন্দর ফেনার বুদ্বুদে তীর ঢেকে যাচ্ছে! চাঁদনী আলোয় তারা গুনা বেশ কষ্টসাধ্য, তবুও গুনতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু অভাবের দায় সে তারা কখনো ঘুচাতে পারবে কী? যারা পেটের দায়ে পিঠ পোড়ে, তাদের কাছে চাঁদনী আলো নিতান্তই পরিহাস।
মাইকের আজান এদ্দূর ভেসে কান পর্যন্ত আসবে না, তবুও বুঝা যাচ্ছে এশার সময় পাড় হয়ে যাচ্ছে। নৌকা চলতে চলতে অবশেষে লক্ষ্যস্থান হানিফ ব্যাপারীর টেকে এসে ভিড়ল। হাওরের মাঝে এমন অনেকগুলো টেক আছে, সবগুলোই প্রায় ডুবো ডুবো অবস্থা। এগুলোই হাওরবুকে জেলেদের মাঝরাতের একমাত্র আবাসস্থল।
সে যাইহোক, অবশেষে তারা সবাই টেকটিতে নৌকা ভিড়িয়ে নেমে পড়ল। নৌকার গলুইয়ের নিচ থেকে বার ফাঁইয়া টানাবেড় জাল বের করে একেক করে সবাই কমড় পানিতে নেমে গেল।
নি ~ ভাই, জালের মাথাটাত ধরো, আমি জালডারে লম্বা কইরা ছাইড়াআই।
মু ~ সুমন, তুই নাও আর লাইটটা লগে লইয়া আয়। আমি, নিরঞ্জন জাল টানতাছি।
নিরঞ্জন নিঃশব্দে জাল টানছে। মুবা মিয়ার সাথে যে তারা এই প্রথম মাছ ধরতে আসছে তা নয়। তবুও, মুবা মিয়া তাদের এটা-সেটা মাছ ধরার কলা-কৌশল বলে দিচ্ছে। তারাও খুব আগ্রহ করে শুনে। প্রায় ঘণ্টা খানেক জাল টানার পর আবার টেকের কিনারে ফিরে চলে এল।
মু ~ নিরঞ্জন, জালের দুইটা মাথার বড়্ একখানো কইরা পানিত ধইরা রাখবি। আর সুমন, জাল টাইন্না নৌকাত তুলবি।
নি ~ আইচ্ছা, ভাই।
অতঃপর তারা জাল টেনে নৌকায় তুলেই আকাশের দিক মুখ করে কিছুক্ষণের জন্য হাঁপাতে থাকল। যেনো শরীরের সব কিছু গলে মুখ দিয়ে গরম শ্বাস হয়ে বেরুচ্ছে। মৃদু হাসি দিয়ে সুমন বলল,
সু ~ ভাই, দেখা যাইতাছে ভালোই মাছ আইছে টানো।
মু ~ আস্তে কঃ। মেলাদিন পর আল্লায় আমরারে একটা মাছের ভাঙ্গতি দিছে। মাইনষে হুনবো তো!
নিরঞ্জন নিঃশব্দে মাচায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। নিস্তব্ধ হাওড়। টেকটিতে ব্যঙের ঘ্যাঙরঘ্যাঙ ধ্বনি ও বাতাসে ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দও শুনা যাচ্ছে না। এতো রাতে আশেপাশে বেশ দূরে কয়েকটা জালের নৌকা দেখা গেলেও তাদের কোনো কথোপকথন তদ্দূর পর্যন্ত যাবে না। তবুও এমনভাবে তারা কথা বলছে যেনো বেড়ার ওপাশ থেকে কেউ কান পেতে বসে আছে। অথচ, প্রায় জনশূন্য হাওরে কাছাকাছি না আছে কোনো মানুষ, আর না আছে কোনো বেড়া। তবুও তারা যেনো সদা সতর্ক।
সরপুঁটি, মাঝারি কালিরা, পাবদা, মাঝারি আইর, বড় পদের বাইলা, গইন্না ইত্যাদি এক এক করে তারা মাছ খুলতে লাগল। নৌকার মাচার তলায় একেক করে মাছ রাখা হচ্ছে।
সু ~ মুবা ভাই, যে মাছ আইছে মনে অইতাছে সহাল সহাল বাজারো যাওন যাইলে ভালোই কামান যাইব।
মু ~ অইছে, থাম এইবার। অতি খুশির পাছায় লাথি। হেদিনের মতন যদি এইবারও অয়, তাইলে আম-ছালা দুইটাই যাইবো। জালের চালানই এই পর্যন্ত উডাইতে পারছি না। আবার পেট চালামু কী দিয়া?
সু ~ হ ভাই, হেদিন এতো কষ্ট করলাম। হারাডা রাইত পানিত পইড়া শিতো কাঁইপ্পা কাঁইপ্পা মাছ ধরলাম। আর শেষে অইলো কী, হুটকি দেওন লাগছে!
মু ~ সুমন, ছইড়া পানিত কুইপ্পা নৌকাডা ছইড়ো বাঁন্ধ।
মু ~ নিরঞ্জন, জাল বাছতে-বাছতে তোরারে একটা মজার কিচ্চা কই, হুনবি?
নি ~ হ ভাই, কইতা পারো।
মু ~ এই যে মাইনষে এই টেহেরে হানিফ ব্যাপারীর টেক কয়। কিল্লিগ্গা কয় তোরা জানস কেউ?
সু ~ নাঃ, ভাই। কিল্লিগ্গা কয়?
মু ~ মেলাদিন আগের কতা। দূর্গাপুর গ্রামের ভূঁইয়াবাড়ির মালেক ভূঁইয়ার বাপের নাম আছিন হানিফ ব্যাপারী। হাওর তার কয়েক হাল জমিও আছিন। ওনি এলকাই এতলা জমির দেখ-ভাল করতেন। অবশ্য বছর-বছর কামলাও রাকতেন এক-দুইটা কইরা। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই ওনি রাইতের আঁন্ধারই একলা-একলা খেতো পানি খেঁচবার লাগি চইলা যাইতেন। একবার অইল কী! রাইতের খাওন খাইয়াই তার ডেহাগরু আর লাঠিডা লইয়া খেতো রওনা দিলেন। আগেকার মাইনষেরা রাইত-বিরাইতে একলা-একলা চলার সময় সাধারণত লগে কইরা কয়ডা পাথ্থরের টুরকা আর লাডি রাখতেন। লগে কইরা আবার উক্কাডাও লইয়া গেছিলেন। তার খেতের লগেই একটা উঁচা জায়গা আছিন। ওনি হেই উঁচা জায়গাডাত বইয়া বইয়াই সারারাইত উক্কা টানতেন আর খেতো পানি খেঁচতেন। হেদিনও ওনি উক্কাত লম্বা কইরা কয়েকটা টান দিয়াই খেতো পানি খেঁচা আরম্ভ করলেন। এর কিছুক্ষণ পরেই ঘটল এক আশ্চর্যজনক ঘটনা। হঠাৎ পিছন থেকে কে জানি ওনাকে একটার পর একটা ইটা মারতাছিল আর পেকমাডি ছুঁড়তাছিল। কিন্তু বিষয়ডা ওনার বুঝার আর বাকি নাই। ওনি কিছুক্ষণের লাগি পানি খেঁচা থামাইয়া ওনার লুঙ্গিত গোঁঞ্জা কয়েকটা পাথ্থর হাতো লইয়া কী যেনো পইড়া ওনার চাইরদিকে ছুঁইড়া মরলেন এবং পাথ্থর যদ্দূ পর্যন্ত ছুঁইড়া মারলেন তদ্দূ পর্যন্ত সাথে সাথে লাডিডা দিয়া একটা দাগ আঁইক্কা দিয়া শয়তান জ্বিনগুলারে দাগের ভিতরে আটকাইয়া লাইলেন। এমনই, হেই জ্বীনগুলা চিক্কার-চেচামেচি শুরু করল। হেইগুলা আর কোনোভাবেই দাগের বাইরে যাইতে পারল না। তই লগে-লগেই জ্বীনগুলা আইসা ওনার পায় পড়া শুরু করল। ওনি হেই শয়তান জ্বিনগুলারে খেতো পানি খেঁইচা দিলে ছাইড়া দিবেন কইয়া হেই টেকটাত ঘুমাইয়া পড়েন। এদিকে ডেহাডা টেকের চাইরদিকে ঘুইরা-ঘুইরা ঘাস খাইতে থাকল আর খেতও পানিতে ভরপুর অইয়া গেল। যহন ফজর আজান পড়ল জ্বিনগুলা আবার চিক্কার করতে করতে হানিফ ব্যাপারীর পায় আইয়া ক্ষমা চাওয়ার লাগল। আজানের সাথে সাথেই জ্বিনগুলার শরীর দিয়া আগুনের ধোঁয়া উড়তাছিল। পরে হানিফ ব্যাপারীর হেদের উপরে মায়া অইলে ওনি হেদেরকে শর্ত মুতাবেক দাগডা মুইছা দিলেই হেই জ্বিনগুলা চোখের পাতি দিতে-দিতেই চইলা যায়। এরপর থেকে নাকি পরতেক রাইতেই হেরা আইসা হানিফ ব্যাপারীর খেতো পানি খেঁইচা দিত। শেস পর্যন্ত এমন হইল যে, ওনার খেতো কহনো আর পানির অভাব দেহা দেয় নাই। অথচ লগের খেতই ঊনাপানি থাকত। পরথম-পরতম ঘটনাটা ব্যাপারীসাব ধামাচাপা দিয়া রাখবার চাইলেও পরে আর ধামাচাপা দিয়া রাখবার পারেন নাই। এক এক কইরা গাঁওয়ের সবাই ঘটনাটা জাইন্না যায়। কালের পরিবর্তনে এই ঘটনাডাই ঐতিহাসিক এক কিচ্চায় পরিনত অয়। ওনি যেই টেহো ঘুমাইয়া-ঘুমাইয়া জ্বীনদের দিয়ে পানি খেঁচাইতেন, পরে হেই টেহের নামই ওনার নামে অইয়া যায় হানিফ ব্যাপারীর টেক।
সু ~ ভাই, অহনও কি জ্বিনগুলা এহানো আছে?
মু ~ হয়তো আছে। কিন্তু হেদিনের পর নাকি আর কেউ হেদেরকে এইহানো দেহে নাই একমাত্র হানিফ ব্যপারী ছাড়া।
নি ~ ওনি যে শর্ত দিছিল, হেইগুলা কী আছিন জানো, মুবা ভাই?
মু ~ হু, জানি।
নি ~ কী?
মু ~ কাউরে যেনো আর কহনো খতি না করে।
সু ~ ভাই, জ্বীন-ভূতের কতো কাহিনী হুনলাম। কিন্তু জীবনে কোনোদিন দেহি নাই। জ্বীন-ভূত দেকতে কেমন আমার দেকবার মেলা শক!
মু ~ দেহামুনে কেউরে ধরলে। অহন কাম শেষ কর তাড়াতাড়ি।
নিরঞ্জন যেনো আগের মতোই আবার নিস্তব্ধ, নিষ্চুপ হয়ে কাজ করতে থাকল। পরে এতো কথা হলো, অথচ নিরঞ্জন নির্বিকার ভঙ্গিতেই সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল। কিচ্ছা-কিচ্ছাতেই তারা জালের বন, কাঁকড়া, শেওলা একটা-একটা করে বেছে-বেছে জালটাকে পরিষ্কার করে নিল। নৌকার সামনের গলুইয়ে রেখে হাত-মুখ ধুয়ে নিল সবাই। গামছার গিঁট খুলে সাদা পাতার বিড়ি বের করলো মুবা মিয়া। অনেক খোঁজার পরও ম্যাচ পাওয়া গেলো না। পরে মুবা মিয়ার মনে হল বাড়ি থেকেই ম্যাচবক্সটা আনা হয়নি।
মু ~ কিরে, তোরা কেউ বিড়ি খাস?
সু ~ নাহ, ভাই। এইডা অহনও ছুঁইয়া দেহি নাই।
নিরঞ্জন কোনো কথা বলছে না।
মু ~ কিরে নিরঞ্জন, তুই খাছ? মুখটাদি আইজ বুজাই লাইলি মনে হয়। হেই পরথম থেইক্কাই দেখলাম তেমন কথা-টথা কইতাছোস না। কী অইছে তোর?
নি ~ কোনো না, ভাই। বিড়ি খাই মাইঝে মাইঝে। মন-টন ভালা না থাকলে।
মু ~ খাছ, না খাছ পরের কথা। ম্যাচ-ট্যাচ আছেনি হেইডা কঃ?
নি ~ ম্যাচ লুঙ্গিত বান্ধা। দেহ আছে, আত দিলেই পাইবা।
মু ~ ধরাইবি একটা?
নি ~ নাঃ, ভাই। আইজ কিছুই ভালো লাগতাছো না আমার। তোমরা খাও।
মু ~ নেহামী বাদ দিয়া কী অইছে কবি?
নি ~ কোনো না।
মু ~ কোনো না অইলেই ভালা। আইচ্ছা, লুঙ্গি তোর পিছেই দেহা যাইতাছে। ম্যাচটা দে বিড়িডা ধরাই।
নিরঞ্জন চুপচাপ নিজের হাতেই লুঙ্গিটা খুলে ম্যাচটা মুবা ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিল। কেমন যেনো তার শিরায় কোনো অবকাশের চিন্তা দোল খাচ্ছে। রাত বাজে হয়তো বারটা কি একট। তবুও চোখে কোনো তন্দ্রা নেই আজ। আজ কারো সাথে তেমন কথা বলতেও তার ভালো লাগছে না।
মু ~ সুমন, তোর ভাউজে কয়ডা সন্দেশ পিডা দিছিল কাগজো কইরা। পাটাতনের নিচে রাকছি। পাটাতনডা আগলি দিয়া দেক।
সু ~ হ ভাই, খাওন যায়। জাল টাইন্না পেটটা খালি অইয়া গেছে।
মু ~ কিরে নিরঞ্জন, মন খারাপ কইর বইয়া থাকবি? খাবি না?
নি ~ ভাই, খাওন যাইবো না পেডো। মনডা ভালা নাই আইজ।
মু ~ ক্যান? কী অইছে কহ খুইল্লা আমারে।
নি ~ ভাই, কেমনে কই কতাডা!
মু ~ কহ ভাই, কোনো সমস্যা নাই। মনে কর, আমি তোর একটা আপন ভাই।
নি ~ভাই, আমার বউয়ের পেডো আমার সাত-আট মাসের বাচ্চা। কিন্তু আইজ কয়েকদিন ধইরা বউডা আমার পেডের বেদনায় ঘুমাইত পারতাছে না। ডাক্তারের ধারে নেওন লাগব। কিন্তু ভাই, জানোই তো, অহন আমার হাত এক্কেবারে খালি অইয়া রইছে। কী করতাম বুঝতাম পারতাছি না। বউ আমার পেডের বিষ্ষে ছটফট-ছটফট করতাছে। কেমনে ডাক্তারের ধারে লইয়া যাই! চিন্তায় কোনোকিছু ভাল লাগতাছে না আমার। খোদাঐ জানে কোন সময় কী অয়!
মু ~ ধুর পাগল, কোনো অইব না তোর বউয়ের। এমন সময়ে মাইনষে ইত্তা চিন্তা করে? হুন, তোর বউ-বাচ্চা সব বাঁচব, ইনশাআল্লাহ। দেহিস, কইয়া দিলাম কিন্ত। আমি আছি, এতলা চিন্তা করছ কেরে? অহন শান্তিমত পিডা খা।
মুবা মিয়া চুরুটটা ঠোঁটে পুড়ে লম্বা-লম্বা টানে চুরুটের ধোঁয়া আকাশে ফুঁকে দিচ্ছে। পূর্ণিমা চাঁদটা কেমন সেই ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। মুখখানা হাত দিয়ে মুছে নিয়ে নৌকার বাতায় সারা শরীর ভর করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো রাতের এই আঁধারে গ্রাম্য, মুক্ত বাতাসেও কারো দম আটকে যাচ্ছে। প্রথম সন্তানের মুখ দেখায় কেউ ছটফট করছে আবার কেউ অন্যের দুঃখকে ভাগ করে নিতে ব্যস্ত। নিদারুণ কষ্টটা যখন স্রষ্টা নিজেই দান করেন, তখন আর কাউকে দোষ দেওয়ার থাকে না। ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন জাত তবুও যেনো মনে হচ্ছে, একি বৃক্ষের দুটি ডাল। এ ডালে নাড়া দিলে ও ডালও যেনো এমনিতেই নড়ে উঠে।