প্রতিটি ভাষার রুপের কারিগর ঐ ভাষাভাষী মানুষ। আমাদের বাংলা ভাষার যে সুন্দর রুপ আমরা বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি তা একদিনে হয়নি।তার পেছনে রয়েছে বাঙালির বহু বছরের সাধনা। বাংলা ভাষার যে রুপ নিয়ে আমরা গর্ব বোধ করি তার বিকাশে গূরত্বপূর্নূ অবদান রয়েছে মুসলিম শাসক ও লেখকদের।
তুর্কি মুসলিন সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলাদেশে মুসলিম রাজত্ব কায়েম করেন।ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নবজন্ম ঘটে। মধ্যযুগে আরবী ফারসি তুর্কি ও উর্দু শব্দের সংমিশ্রণে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়ে উঠে।
বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কবি ও লেখকদের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য অবদান রোমান্টিক ও আধ্যাত্ম প্রণয়কাহিনী। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় মুসলিম সাহিত্যিক গন বেশী অবদান রাখেন সুলতানী আমলে।তার পূর্বে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের কবিরা দেবদেবীর
মাহাত্ম ও শুদ্ধ সাধন পদ্ধতি নিয়ে লেখালেখি করেছেন। মানবীয় বিষয় নিয়ে তারা চিন্তা করেননি। মুসলিম কবি লেখকরা মানবীয় বিষয় ও ধর্মকে প্রাধান্য দেন তাদের লেখায়।
প্রাচীন যুগে বাংলা সাহিত্যের প্রথম বই চর্যাপদের রচয়িতা ছিলেন বৈষ্ণব কবি গণ।সে সময়ের আরো দুটি বই ডাকার্নব ও দোহাকোষ।সে যুগে মুসলিম লেখকদের লেখা সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় নি।
মধ্যযুগে মুসলিম লেখকগন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় বিশেষ ভাবে এগিয়ে আসেন সুলতানী আমলে । কাহিনী কাব্য আর রোমান্টিক কাব্য ধারার প্রবর্তনে মুসলিম লেখকদের অবদান অনেক বড়। মুসলিম লেখকদের রচিত সাহিত্যে মানুষের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়।
মধ্যযুগের মুসলিম কবিদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন শাহ মুহাম্মদ সগীর। সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের রাজত্বকালে তার বিখ্যাত কাব্য ইউসুফ জুলেখা রচিত হয়। ফেরদৌস ও জামির ইউসুফ জুলেখা কে তিনি বাংলা কাব্যের মর্যাদা দান করেন।। যা নবী হযরত ইউসুফ (আ)এর জীবনকাহিনী।
আলাওল সপ্তদশ শতকের কবি।কারো মতে তিনি ফরিদপুরে লোক আবার কারো মতে চট্টগ্রামে র লোক।তার জীবনে রয়েছে বিভিন্ন সুখদুঃখের টানাপোড়েন। মধ্যযুগের মহাকবি আলাওল তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ পদ্মাবতী রচনা করেন।রোসাঙ্গ রাজের প্রধানমন্ত্রী মাগন ঠাকুরের আশ্রয়ে ও অনুপ্রেরনায় আলাওল পদ্মাবতী রচনা করেন। হিন্দি কবি মালিক মূহম্মদ জায়সীর পদুমাবুত অবলম্বনে পদ্ধাবতী কাব্যরচনা করেন। মাগন ঠাকুর ছিলেন কোরেশ বংশোদ্ভূত মুসলমান। আরাকানের রাজা কর্তৃক তার উপাধি হয় ঠাকুর। তিনি নিজেও কবি ছিলেন।মাগন ঠাকুরের কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে চন্দ্রাবতী। সৈয়দ মুহাম্মদ এর আদেশে আলাওল তার হপ্তপয়কর কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। সুধর্মার রাজসভার নবরাজ মজলিস এর আদেশে আলাওল সেকান্দর নামা রচনা করেন।
হানিফা ও কয়রা পরীর গল্প লিখেছেন সাবারিদ খান।
মুসলমান কবিরা শুধু মুসলিম সাহিত্য নিয়ে কাহিনী কাব্য লিখেননি।ভারতীয় কাহিনী নিয়ে লিখেছেন। মুহাম্মদ কবির এর মধুমালতি ও সাবারিদ খান এর বিদ্যাসুন্দর এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যেখানে দেবদেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে।
কবি মোজাম্মিল রচনা করেন নীতি শাস্ত্রবার্তা ও সায়াৎনামা।
গৌড়ের সুলতান ইউসুফ শাহের আমলে সুফী ধারার অনুসারী জৈনুদ্দিন রচনা করেন রসুল বিজয়।যা ফারসী থেকে নেয়া হয়েছে। জৈনুদ্দিন গৌড়ের সুলতান ইউসুফ শাহের সভাকবি ছিলেন।রসুল বিজয় যুদ্ধ বিষয়ক কাহিনী কাব্য। কাহিনী তে হযরত মুহাম্মদ (সা. )ও জয়কমের মধ্যকার যুদ্ধের কাহিনী বর্ধিত হয়েছে।
মধ্যযুগের কবি নসরুল্লাহ খাঁ রচনা করেন তার বিখ্যাত কাব্য জঙ্গনামা।এক তার আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ।
ষোল শতকের মধ্যভাগে কবি দোনা গাজী তার বিখ্যাত কাব্য সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল লিখেন ।আলিফ লায়লা অবলম্বনে তিনি এটি রচনা করেন।
মধ্যযুগের আরেক বিখ্যাত কবি আব্দুল হাকিম। তিনি বঙ্গবানী কবিতার জন্য অধিক পরিচিত।এটি তা নূরনামা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত একটি কবিতা। এ কবিতায় তিনি বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা কারীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছেন এভাবে—-
” যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবানী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি”
মধ্যযুগের কবিদের মধ্যে শেখ ফয়জুল্লাহ বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। তর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ —- গোরক্ষ বিজয়, গাজী বিজয়,সত্যপীর ,জয়নবের চৌত্রিশা ও রাগনামা।সত্যপীরের আধ্যাত্মিক সাধনা অবলম্বনে সত্যপীর ও মহরমের মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে জয়নবের চৌত্রিশা রচিত হয়। তার রাগনামা কে বাংলা রচিত প্রথম সংগীত কাব্য হিসেবে গননা করা হয়।
দৌলত উজির বাহরাম খার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ লাইলী মজনু।এটি ফরসি কবি জামির লাইলী মজনু কাব্যের ভাবানুবাদ।
তার প্রকৃত নাম ছিল আসা উদ্দিন। তিনি আরবী ফারসি ও সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। আমির পুত্র কায়েস বাল্যকালে বনিক কন্যা লাইলীর প্রেমে পড়ে পাগল হলে পাগল তথা মজনু নামে পরিচিত হন। তার আরেকটি আখ্যান কাব্য ইমামবিজয়।
মধ্যযুগের কবিদের মধ্যে সৈয়দ সুলতানের নাম উল্লেখযোগ্য।তার কাব্যগ্রন্থ নবীবংশ।
আধুনিক যুগে বাংলা ভাষায় মুসলিম ঐতিহ্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে শেখ আব্দুর রহিম এর অবদান উল্লেখযোগ্য।তার প্রথম গ্রন্থ হযরত মুহাম্মদ ( সা.) ‘র জীবন চরিত ও ধর্মনীতি এক অনন্য সৃষ্টি। মোহাম্মদী সাহিত্য পত্রিকায় তার লেখা থেকে সে সময়কার মুসলিম বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনা পাওয়া যায়।
মাওলানা মনিরুজ্জামান এর ” ভারতে মুসলমান সভ্যতা তার সে সময়ের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কীর্তি।
এ যুগের আরও কয়েকজন উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক হলেন দীন মুহম্মদ, এয়াকুব আলী চৌধুরী,কাজী আকরাম হোসেন যারা বাংলা সাহিত্যের বিকাশে অবদান রেখেছেন।
শিখা পত্রিকার নামে পরিচিত শিখা গোষ্ঠীর প্রাণপুরুষ আবুল হোসেন ও লেখক কাজী আব্দুল ওদুদ মুসলিম বাংলা সাহিত্যে অনন্য অবদান রাখেন।
গোলাম মোস্তফার সাহিত্য চর্চা দেশভাগের পূর্ব থেকে পূর্ব পাকিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলা সাহিত্যে ইসলামী ভাবধারার রুপায়নই ছিল তার সাহিত্য সাধনার মূল লক্ষ্য। তার বিখ্যাত রচনা বিশ্বনবী। এ সময়ের বাংলা সাহিত্যে যেসব মুসলিম সাহিত্যিকদের অবদান ছিল তারা ছিলেন মোহাম্মদ আকরম খাঁ, ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ,এস ওয়াজেদ আলী,কজী মোতাহার হোসেন , মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আব্দুল কাদির,বন্ধে আলী মিয়া, জসীম উদ্দিন বেগম সুফিয়া কামাল উল্লেখযোগ্য।
মীর মোশাররফ হোসেন ছিলেন আধুনিক যুগের মুসলিম বাংলা সাহিত্যিকদের মধ্যে অগ্রগণ্য।কারবালার মর্মান্তিক কাহিনী নিয়ে রচিত বিষাদ সিন্ধু তার অন্যতম রচনা। তার রচনা থেকে পরবর্তী তে মুসলিম সাহিত্যিক গন অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।
এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কায়কোবাদ।মহাশ্বশান তার অন্যতম কাব্যগ্রন্থ।মহাশ্বশান পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ নিয়ে রচিত মহাকাব্য। তার আরেকটি গীতিকাব্য অশ্রুমালা।
বাংলাদেশ পর্বে মোহাম্মদ নজিবুর রহমান, আবুল ফজল,কাজী আব্দুল ওদুদ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।ওয়ালী উল্লাহ র লাল সালু ,চাঁদের অমাবস্যা বিখ্যাত রচনা। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর চন্দ্র দীপের উপাখ্যান অনন্য রচনা। রাজিয়া খান জহির রায়হান, রিজিয়া রহমান, শামসুর রহমান, হূমাযন আহমেদ,সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ূন আজাদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস,আহমদ শরীফ,আহমদ ছফা প্রমুখের লেখায় বাংলা সাহিত্য উৎকর্ষতার পথে এগিয়ে গেছে অনেকখানি।
পরিশেষে নির্দ্বিধায় বলা যায় -মুসলিম কবি লেখকরাই সর্ব প্রথম অতি প্রাকৃতের বেড়াজাল ছিন্ন করে মধ্যযুগের সাহিত্যে দৈব কাহিনীর পরিবর্তে মানবীয় কাহিনীর সন্নিবেশ করেন ।যার ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এক অনন্য স্বকীয় মর্যাদা লাভ করে।