রহিম মিয়া মেঘনা পাড়ের লোক। পেশায় একজন কৃষক। দুটো গরু আছে। কয়েক কাঠা ধানী জমি আছে। এইবছর আল্লাহর রহমতে ভালো ধান হয়েছে। সারাদেশের মানুষ যদিও করোনা নামক এক অদৃশ্য ভাইরাসের আতঙ্কে তটস্থ, এই গ্রামে তেমন আতঙ্ক নেই। বরং এবছর গ্রামের মানুষগুলো একটু খুশি খুশি। কারণ ধান হয়েছে ভালো। নদীতে মাছও আছে। আম-কাঁঠাল ও বেশ ভালো হয়েছে। গত কয়েক বছরে এবারই গেরস্ত বাড়িতে ফল-ফলাদি ভালো হয়েছে। স্কুল বন্ধ থাকায় গ্রামের বাচ্চাদের মধ্যেও একরকম উৎসব উৎসব ভাব। বিকেল হলেই কর্দমাক্ত মাঠগুলোতে কাদায় মাখামাখি হয়ে ছেলেদের ফুটবল খেলতে দেখা যায়। আর প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় মেয়েরা বৌচি,গোল্লাছুটসহ নানানরকম গ্রাম্য খেলায় মেতে থাকে। ছেলেমেয়েরা বাড়ির আঙিনায় শাক সবজির চাষও করছে বেশ। গতবছরের তুলনায় ধানের দামও কিছুটা বেড়েছে। অবশ্য ধান বেচে এখন আর পোষায়না তেমন। তবু নিজেদের চাল-শাকসবজি আর নদীর মাছে বছরটা ভালোয় ভালোয় কেটে যাবে এমন আশা গ্রামের সবার। তাসত্ত্বেও টেলিভিশনে খবর দেখলে কিছুটা ভয় পায়,রহিম মিয়া । আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে,”আল্লাহ্ এমন মউত যেন কপালে না জুটে। পোলাপাইনে বাপের লাশ ছোঁয়না, দাফন নাই, কাফন নাই। লাডি দি গুতাই গুতাই নি কবরে হালায়। তওবা। তওবা।শত্রুরও জানি এরম মরণ না অয়।” এ গ্রামের অনেক মানুষ আবার মনে করে যে এগুলো ভুয়া। শহরের মানুষের মনে যে কত রকম কী কাজ করে। একেকবার একেক ঢং। কেউ কেউ মনে করে করোনা শুধু পাপী বান্দাদেরকে ধরবে। এগ্রােমের কুদ্দইেচ্ছার করোনা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ কুদ্দুইচ্ছা প্রচুর জালাইছে গ্রামের মানুষকে। তবে মুখে যে যাই বলুক মসজিদে আজকাল ভীড় খুব। মুরব্বীরা ছেলেমেয়েদের বুঝাচ্ছে,”আল্লারে ধর। এসব আল্লার গযব। আল্লার ঘর পবিত্র জায়গা। হিয়ানে কোন ভাইরাস যাইতনো।”
প্রতিদিনের মত সেদিনও এশার নামায পড়ে সবাই খেয়ে দেয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।
হঠাৎ বাইরে থেকে চিৎকার শোনা গেল,” পানি পানি”
মেঘনার পাড়ের এই মানুষগুলোর একটাই ভয় পানি, ভরসাও পানি।
চিৎকার শুনেই রহিম মিয়ার স্ত্রী জমিলা বেগম ব্যস্তসমেত হয়ে পড়লেন। চারদিকে হাঁক-ডাক শুরু করলেন,”গোছা,গোছা সব গোছা।” রহিম মিয়া ছুটলেন বাহিরে।”আমি গরুগা চাই আই।” পেছন থেকে মেয়ে ডাকছে, “আব্বা যাইয়োনা,আব্বা। ডুবি যাইবা” রহিম মিয়া তবু ছুটলেন। সন্তানের মত এই গরু তার। ছুটে বেরিয়েছেন,ততক্ষণে পানির স্রোত তাদের বাড়ির মধ্যে চলে এসেছে। রহিম মিয়া পানির স্রোতের ধাক্কা উপেক্ষা করে ছুটছেন গোয়ালঘরের দিকে। কিন্তু পারেননি। জোয়ারের তোড়ে নিজেই পড়ে গেলেন। এদিকে জমিলা বেগম ছেলেমেয়েদেরকে টেবিলের উপর উঠে বসতে বলে নিজে ছুটলেন ধানের গোলার দিকে। কিন্তু ততক্ষণে পানি ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। ছেলেমেয়েরা মাকে বাধা দিলো। জমিলা বেগম ও বুঝলেন ধান ডুবে গেছে। তার চেয়ে বড় কথা ছেলেমেয়েগুলোকে চোখের আড়াল করতে চাননা। তাই সন্তানদের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। পরিস্থিতির সাথে কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার পর মেয়ে মর্জিনা বলে উঠলো,”আব্বা কই মা?” এতক্ষণে জমিলা বেগমের হুঁশ হলো,”মর্জিনার বাপ,মর্জিনার বাপ” করে চিৎকার জুড়ে দিলেন। একেতো রাত। এরই মধ্যে উঠোনে গলা পরিমাণ পানি। কোথায় গেলো লোকটা। এদিকে চেরাগটাও নিভে গেছে। এবার ছেলেমেয়েরা কান্না জুড়ে দিলো। জমিলা বেগম দিশেহারা হয়ে পড়লেন। কোন উপায় না দেখে মনে মনে দোয়াকালাম পড়তে শুরু করলেন। ছেলেমেয়েদেরকে বললেন,”চাইরকুল হড় বাপ। আল্লাহ ছাড়া কেউ তোর বাপরে বাঁচাইতে হরেতনো।” এভাবে রাতটা কোনমতে কেটে যায়। সকালের আলো ফুটতেই জমিলা বেগম বেরিয়ে পড়লেন স্বামীর খোঁজে। ততক্ষণে গ্রামের মেম্বার-চেয়ারম্যানের লোকজনও বেরিয়ে পড়েছে। টর্চ হাতে। উঠোনে গরুগুলোর লাশ ভাসছে। কিন্তু রহিম মিয়া নেই। জমিলা বেগম একবার পশ্চিমে যান একবার পূবে। রহিম মিয়া নদীর পাড়ের ছেলে। নদীর সাথে নিত্য সংগ্রাম করেই বড় হয়েছেন। এই পানিতে তার ডুবে মরার কথা নয়। সেই আশায় জমিলা বেগম ছুটছেন। ছুটতে ছুটতে একপর্যায়ে সত্যিই পেয়ে গেলেন। দুইবাড়ি পরে একজনের বাড়ির সামনে একটা মাচার উপর। ততক্ষণে মেম্বারের লোকজন কলা গাছের তৈরী ভেলা নিয়ে সেখানে হাজির হলেন। রহিম মিয়ার জ্ঞান ছিলো তখনও। কিন্তু শরীরে কোন শক্তি ছিলোনা। তাকে মেম্বারের লোকেরা স্যালাইন-পানি খাইয়ে কিছুটা সজীব করে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করলো। জমিলা বেগম ও যেতে চাইলো। কিন্তু তাকে অনেক বুঝিয়ে ছেলেমেয়েদের কথা বলে বাড়ি পাঠানো হলো। জমিলা বেগম কেবল বাড়ি পৌঁছুলেন, তখনই পাশের বাড়ি থেকে হাউমাউ কান্নার আওয়াজ এলো। জমিলা বেগম খুবই ক্লান্ত ছিলেন-তবু একজন মায়ের কান্না উপেক্ষা করতে পারলেননা। ছুটে গেলেন। গিয়ে দেখেন পাশের বাড়ির আছিয়া মাতম করেই যাচ্ছেন। প্রথমে ঘটনা বুঝে উঠতে না পারলেও একটু পর বুঝলেন যে, আছিয়া ভাবীর আড়াই বছরের বাচ্চাটা পাওয়া যাচ্ছেনা। এতটুকুন বাচ্চা এই গলা সমান পানিতে কই যাবে?
সবাই মিলে আবার ছুটলো। আছিয়া বেগমের স্বামী ইতোমধ্যে অর্ধশত ডুব দিয়ে ফেলেছেন পানিতে। গ্রামের লোকজন ও খুঁজতে শুরু করলো। ঘণ্টা তিনেক খোঁজর পর সবাই আশা ছেড়ে দিলো। এদিকে আছিয়া বেগম কিছুক্ষণ থামেন একটুপর আবার চিৎকার করে ওঠেন।”আমার বুকের মানিক কই গেলি? ও আল্লাহ তুমি এডা কী করলা। আল্লাগো। আমার মানিক কইগো। আল্লাহ কী পাপ করছিগো। এই শাস্তি দিলা ক্যান?আল্লাহ আমারে ক্যান থুই গ্যালা?”
সেদিনটা খেয়ে না খেয়ে কেটে গেলো। আশেপাশের কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নৌকায় করে খাবার পাঠিয়েছিলো। কিন্তু আছিয়া বেগমের মুখে খাবার ওঠেনি। জমিলা বেগমও পারেননি খাবার মুখে তুলতে। কেমন আছে রহিম মিয়া কেজানে। এখনও কোন খবর আসেনি।
সেদিন বিকেলে একটা শিশুর লাশ ভেসে উঠলো গ্রামের শেষ প্রান্তে। লাশটা আনা হলো আছিয়ার সামনে। আছিয়া ছেলের লাশ কোলে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। আর কোন কথা বলছেননা। কেউ কাছে আসতে চাইলেই তেড়ে যান। অনেক চেষ্টা করেও কেউ তাকে নিবৃত্ত করতে পারলোনা। সেদিন রাতটা তিনি এভাবেই কাটিয়ে দিলেন।
পরদিন ভোরে আছিয়ার লাশটাও পানিতে ভেসে উঠলো। কিন্তু তখনও তার বুকের মানিক তার বাহুডোরে শক্ত করে ধরে রাখা।