পোষ মাষের প্রথম দিকেই জমিতে ধান বুনার ধুম পড়ে যায়। এই হাওরাঞ্চলে বছরে বার একের বেশি ফসল ফলানো যায় না। অনেককে আবার এই এক বারেই নদী-জোয়ারের কবলে পড়তে হয়।
চোখ যদ্দুর যায়, শুধু সবুজ সোনালী পাতায় ঘেরা মাট-ঘাট। নতুন শস্য-সবজি চতুর্দিকেই বিস্তৃত। পানি নেই, কাঁদা নেই, বৃষ্টি নেই, চতুর্দিকে শুধু প্রকৃতির রাজত্ব। সরষে ফুল, সয়াবিন ফুল, চালকুমড়ো ও মিস্টিকুমড়োর কুঞ্জবন মধুকরদের গুঞ্জনে মুখরিত।
এমনই এক শীতের ভোর_কনকনে ঠান্ডা। বাহিরে হিম-শিশির আর কুয়াশার অন্ধকার। কাঁথার নিচ থেকে বের হওয়াই ধমার্ধম। তার উপর ঘরের ভিতরে টিনের চাল হতে চুয়ে-চুয়ে ফোঁটা-ফোঁটা শিশির পড়া। ফজরের আজান পড়ছে মাত্র। কাঁথা সরাতেই গায়ের লোমগুলো খাঁড়া হয়ে উঠল মুবা মিয়া। ইশ্শ! কী শীত। হঠাৎ কেঁপে উঠল তার শরীর। এই মুহূর্তে শুয়ে থেকে কিছুক্ষণের সুখের জন্য পরিবারকে পরদিন না খেয়ে কাটাতে দিতে পারে না মুবা মিয়া। তড়িঘড়ি করে খাট ছেড়ে বেড়ায় গুঁজা পলিথিন থেকে একটিপ ছাই নিয়ে দাঁত ঘষতে-ঘষতে গনি মিয়ার টিউবওয়েল থেকে হাত-মুখ ধুয়ে পাতিলায় হাত দিল। উঠে কয়েক দানা পেটে না পুড়ে কাজে গেলে সারা সকাল আর পেটে খাবার জুটবে না। সকালে কোনো গেরস্তই খাবার দিবে না- এ রীতি এ গ্রামে অন্তত নেই। রাতের কয়েক মুঠো পান্তা ছিল। বরফগলা পান্তায় হাত দিতেই ঠান্ডায় হাত কেঁপে উঠল। বদলা দিতে যাবে কোনো গেরস্তের বাড়িনা জানি কী কাজ দেয়। এ ঠান্ডা পান্তা খেয়ে কাজই বা কীভাবে করবে! রাগে-ক্ষোভে ঘরের আলমারি, ডেকচি, বৈয়াম ইত্যাদি এক-এক করে সব দেখে ফেলল, অথচ কোথাও এক-আধি ছটাক খাবার পর্যন্ত নেই। সামান্য কিছু চালভাজা-সাতু কাল মাত্র ইব্রাহিম শেষ করল। মুড়ি-টুড়িও নেই বৈয়ামে। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে সবকিছু তন্নতন্ন করে খুঁজে ব্যর্থ হল। খই ফুটানোর বালু নেই, পিঠা বানানোর চালের গুড়ি নেই। সুতরাং, পার্শ্ব খাবার নিতান্তই সখ্যতা। যাইহোক, কাঁপা-কাঁপা হাতে বড়-বড় করে কয়েক মুঠো ঠান্ডা পান্তা চোখ বন্ধ করে গিলে নিল। তাড়াহুড়া করে প্রস্তুত হতে লাগল। ফাতেমার মা এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে।
ফা মা ~ সময় থাকলে একটা মুরগার বয়দা আছে ভাইজ্জা দিমু?
মু ~ নাহ। লাগব না। তুমি ঘুমাও। নাইলে উইঠা নামাজ পড়।
মাফলারটা কান বরাবর পেঁচিয়ে নাক-মুখ ছাড়া পুরু চেহারাটা ঢেকে নিল। ফাতেমার মা জ্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
খা-মা ~ আইজ দুইদিন ধইরা ঘরো মাছ নাই। আইবার সময় কয়ডা মাছ আনবেন নি?
মু ~ ওই রাইখ্যসনী, এতো খাম-খাম করস ক্যান? এইডা আইন্না দেও হেইডা আইন্না দেও। তোরার পেট এমনে গোলাঘর বানাই রাখছোস ক্যান, হ্যা? এতো বাজার কি চাল ফাইরা আসমানতে পড়ব?
ফা-মা ~ ঘরো কিচ্চু নাই।
মু ~ না থাকলে না খাইয়া মর। অন্তত আমি শান্তিতে থাকতাম পারমু। তোরার পেডো খাওন জুটাইতে-জুটাইতে আমার কাম বিনাশ অইয়া যাইতাছে।
ফা-মা ~ এই বিয়ানে এতো জোরে কতা কইয়েন না। পোলা-মাইয়া সব ঘুমাইতাছে, উঠবো তো?
মু ~ নাক টাইন্না ঘুমানি আর হুইয়া থাকুন আমার ঘরো চলবো না। যার-যার পেডের ধান্দা কর অহন থেইকা। আমি আর পারি না।
“আমি আ,,,,,,র পারি না” বাক্যটা দুইবার উচ্চারণ করে-করে চোখের জল মুছতে-মুছতে মুবা মিয়া ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ফাতেমার মা খাটের পায়া ধরে মাটিতেই বসে পড়ল।
দু’শ-তিনশ টাকার জন্য সারাদিন কলুরবলদের মতো বদলা খাটতে হয়। কখনো ধানের জালা রোপন করা, জমির আইল বাঁধা, কখনো জমিতে মই দেয়া, বন বাছা, কখনো বা পানি সেঁচা ইত্যাদি নানান রকমের কাজ করতে হয় বদলায়।
বড় এক গেরস্তের জমিতে আজ জালা বুনার বদলা পেয়েছে। আধহাত-একহাত পানিতে জালা বুনতে নেমে সারা শরীরের কম্পনে দাঁতে দাত লাগিয়ে খট-খট করে কাঁপতে থাকল মুবা মিয়া। তবুও উঠে আসতে পারছে না সে। গ্রামীণ মানুষগুলো গ্রীষ্মের দাহে দহে আবার শীতের কম্পনে কেঁপে-কেঁপেই বড় হয়ে উঠে। যেনো এ গাঁয়ের গণ্ডিতে তারা দড়িবাঁধা কোনো প্রাণী। তাদের নিকট এমন সব কাজ-কর্ম নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুনা যেতো রোজ প্রতি বদলার মূল্য ছিল বিশ টাকা আর এক মণ ধানের মূল্য ছিল সত্তর কিংবা আশি টাকা। এক মণ ধান জুগানোর জন্য যেখানে তিন-চার রোজ বদলা দিতে হতো আর এখন এক বদলা দিয়েই সে ধান অনায়াসে পাওয়া যায়, কিন্তু তবুও যেনো কৃষকরা প্রতিনিয়তই এক মুঠো পান্তার জন্য জীবনকেে পানির মতো হিসেব করছে। মনে হয়, নীলকর রাজ্য গড়ে উঠেছে এখানেও।
মু ~ মূসা ভাই, ও মূসা ভা,,,,ই, আগে হুনতাম ধান-চাইলের কত্তো দাম আছিন! ক্ষেত জমাও বহুত আছিন। আবার সার লাগত না, বিষ লাগত না। ধানও অইত বহুত, দামও আছিন মেলা। কিন্তু অহনের যুগে এতো যত্ন-তালাফি কইরাও আগের অর্ধেক দামও পাওয়া যায় না, ধানও তেমন ভালা অয় না। আর সরকার খালি কয়, দেশে বাম্পার ফলন অইছে, বাম্পার ফলন অইছে। সব সরহারের চাইল ভাই, সব সরহারের চাইল। কৃষকরার বাঁচার দিন শেষ। হেরা কৃষক মাইরা শিল্প-ইনডাসটি গইড়া তুলতাছে না, শরীরের রক্ত বেঁইচা স্টাইল শিখুন লাগছে।
মূসা ~ ঠিকই কইছোস, মুবা। সরহার যদি ভালা কইরা পদক্ষেপ নিতো, তাইলে কি আর আইজ কৃষকরা এমনে মরত?
মু ~ হ ভাই, আল্লাঅই আমরার সহায়।
মুখ আর হত যেনো সমান তালে চলছে সবার। কাজেরও একটা শিল্প, তাল আছে। মুখে মুখের কাজ, হাতের কাজ। এ যেন জমির ইঞ্জিনিয়ার।
সকাল হয়ে অর্ধদুপুরও হয়ে যাচ্ছে, তবুও কুয়াশা ছাড়ার কোনো নামগন্ধও নেই। ওদিকে আবার হাড়কাঁপা শীতেই কোনোরকম চাদর পেঁচিয়ে ফাতেমা ও ইব্রাহিম মক্তব থেকে ফিরে এসে খোলা হতে গরম-গরম চটা-পিঠা খেতে বসেছে শুকনেমরিচ ও শুটকি বাটা ভর্তা দিয়ে। হঠাৎ এক টুকরো পিঠা ছিঁড়ে মুখে দিয়েই ফাতেমা বলল,
ফা ~ আম্মা, কয়দিন ধইরা তোমারে একটা কতা কইতাম, কিন্তু সাহস অইতাছে না, কেমনে যে কই!
খোলার পিঠা উল্টাতে-উল্টাতে ফাতেমার মা বলল,
ফা মা ~ কী অইছে খুইল্লা কঃ। না কইলা বুঝমু কেমনে কী হইছে?
ফা ~ আম্মা, হেই বাড়ির কয়ডা পোলাপান আছে, আমার মক্তব-মাদ্রাসাত আইতে-যাইতে হুদাহুদি বিটলামি করে, শয়তানি করে। মাইঝে মাইঝে কী সব খারাপ-খারাপ কথাও কয়।
ফা মা ~ কী কয়?
ফা ~ তোমার লগে হেইডা কইতাম পারমু না। কতাগুলা খুব খারাপ।
ফা মা ~ কইতে পারবি না, তই কইতে আইছোস ক্যান?
ফা ~ আমারে ভাউজ-ভাউজ কইয়া ডাহে।
ফা মা ~ ভাউজ ডাকব ক্যান? তুই ভাউজ ডাহার মতো কী করছোস?
ফা ~ আম্মা, বিশ্বাস করো, আমি কিচ্ছু করি নাই। এইগুলা হুদাই আমারে বিরক্ত করে।
ফা মা ~ তুই কিছু করোস নাই তো?
ফা ~ না, মা, আমি কিচ্ছু করি নাই। এই মাথাত ধইরা কইলাম।
ফা মা~ আইচ্ছা, আমি দেখমুনে কেডা কী কয়। যাঃ, গডি দুইডা লইয়া ঘাটতে পানি আইন্না দে আমারে। আমি রান্ধুনের ব্যবস্থা করি।
ফাতেমা একটি কলসি কাঁধে ও আরেকটি কলসি হাতে নিয়ে ঘাটে গেল পানি আনতে। আবার সেই বখাটে পোলাগুলো ফাতেমাকে সিটি দিতে-দিতে ভাউজ-ভাবি বলে ডাকতে লাগল। ফাতেমা ওড়না দিয়ে কোনোরকম মুখ ঢেকে ঘাটের পানিতে কলসি বুড়িয়ে চলে আসে।
ফাতেমা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না এ কী হচ্ছে তার সাথে। এ সব পোলাপানগুলো হঠাৎ ক’দিন যাবৎ তার সাথে এমন করছে কেনো? কী-ই বা তাদের সাথে এমন কিছু করেছে সে? কোনো কিছুর হিসেবই তার কাছে স্পষ্ট না।
মুবা মিয়ার ফিরতে-ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। হাতে তেলাপিয়া মাছ আর পাটশাকের দুইটা আঁটা। শার্ট-লুঙ্গিতে কাঁদা লেগে আছে। উঠোনে পা রাখতেই আকষ্মিক চমকে উঠল মুবা মিয়া, “আরে ময়না, কখন আইলি তুই?”
কোনো উত্তর করল না ময়না।
মু ~ কিরে, কথা কস না ক্যান?
ময়না নিথর হয়ে পড়ে আছে। মুখে শব্দ নেই। উঠোনের একেক কোণে একেকজন খুঁটি ধরে বসে আছে। কারো মুখে কোনো সারা-শব্দ নেই। নিস্তব্ধ-নিরাকার ভঙ্গিতে সবাই।
মু ~ ময়না, তোর কী হইছে বইন কঃ। এমনে মুখ থুবড়ে বইয়া থাকলে অইব?
এমনই ময়না হু-হু করে কেঁদে উঠল। গড়গড়িয়ে চোখের পানি গাল বেয়ে পড়তে লাগল। কাছে যেতেই ময়না ভাইকে জরিয়ে ধরে আরো জোর গলায় কাঁদতে লাগল। কিছুতেই যেন কান্না থামছে না। কান্নায় গুঙাতে-গুঙাতে গলা ভার হওয়া কণ্ঠে বলল, ” ভাইরে, আমার সব শেষ অইয়া গেছে। আমার সব শেষ অইয়া গেছে।”
মুবা মিয়া বোনের চোখের পানি দু’এক ফোটা মুছে দিয়ে বলল, ” কী শেষ হয়ে গেছে বল আমারে।”
ম ~ হাসানের বাপেরে পুলিশে ধরছে।
ময়না আবার হুর-হুর করে কেঁদে উঠল।
মু ~ এমনে কান্দিস না, ময়না। সব খুইলা কঃ কী হইছে?
ম ~ হাসানের বাপ মাইনষেরে বর্ডার পাস কইরা বিদেশ পাঠাইত। ফখরুদ্দিন সরকার আইয়া সব বন্ধ কইরা দিছে। টানা ধর-পাকড়ও চলতাছে কয়েকদিন যাবৎ। প্রায় ২০-২৫ দিন হাসানের বাপ পলাইয়া আছিল। একদিন রাইত বারটা-একটার দিকে আমরার কাছে আইয়া হাতে কয়েকটা টেকা ধরাই দিয়া যাইবার সময় কইয়া গেছে, কয়েকদিন আমরার লগে কোনোরকম যোগাযোগ রাখতে পারব না। আমরা বাপের বাড়ি চইলা যাইতে। কিন্তু হেদিন ফিরবার সময়ই শত্রুতামি কইরা কে জানি হাসানের বাপেরে পুলিশ দিয়া ধরাই দিছে। অহন হুনি, মানুষ পাচারের অপরাধে পাঁচ বছরের সাজা অইছে নাকি হাসানের বাপের। অহন আমরার কী অইব রে, ভাই? কেমনে চলমু? কই যামু? কই খামু?
মুবা মিয়ার একফোঁটা চোখের অশ্রু গাল বেয়ে একটি শুকনো পাতায় টপ করে পড়লে পাতাটি কেঁপে উঠল। ফেলফেল আঁখিতে হাসানের দিকে চেয়ে আছে। মজ্জা মিয়া ও তার বউ বারান্দায় গালে হাত দিয়ে বসে আছে। ফাতেমে মায়ের হাত রেখে পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। হারিস মিয়া কেমন যেন হুঁকার ধোয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে। কিছু কষ্ট সান্ত্বনায় শোক বাড়ায়। কিছু কষ্ট অভাগীর বেঁচে থাকার খোরাক।
গরুর গাড়ির মতো ঠেলে-ঠেলে চলা পরিবারটা হঠাৎ করেই কেমন যেন থমকে গেল। বোনজামাই জেলে, একমাত্র ভাগ্নেও ছোট। উপার্জন করাও তাদেরপক্ষে সম্ভব না। নিজের পরিবার চালাতেই রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে মুবা মিয়ার। তার উপর বোন-ভাগ্নে। ফেলেই বা দিবে কীভাবে। বিপদ ছাড়া কেউ কী আর সহজে বাপের বাড়ি আসতে চায়? এই একটি কারণেই হয়তো-বা গ্রামীণ মেয়েরা বাপের বাড়ির সম্পত্তি কখনো নিতে আসে না। হারিস মিয়া নিঃশব্দে হুঁকা টানছে আর টানছে। উঠোন ছেড়ে ঘরের চাল বেয়ে ধোঁয়া উড়ে যেতে লাগল। একটু পরই দূর থেকে ভেসে আসতে লাগল সূর্যাস্ত সময়ের উপাসনার আহ্বান “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার”।